‘দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু ছেলে ফিরেনি’ – শহীদ আরাফাতের মায়ের আক্ষেপ

মায়ের স্বপ্ন ছিল—তার একমাত্র ছেলেটি লেখাপড়া শিখে একদিন সেনাবাহিনীতে চাকরি করবে। দেশের সেবা করবে। বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্নের কুঁড়ি পাঁপড়ি মেলে ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরে গেছে অকালে।
ফ্যাসিবাদী সরকারের লেলিয়ে দেওয়া উন্মত্ত পুলিশ বাহিনীর ছোড়া ঘাতক গুলি কেড়ে নিয়েছে তার বুকের ধন আরাফাতের তাজা প্রাণ। তার স্বপ্ন নিমেষেই পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে এক নিঃসীম শূন্যতার বিভীষিকায় নিরন্তর হাতড়ে ফেরাই যেন তার নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আশুলিয়া থানার সামনে পুলিশের ছোড়া গুলি বুকে লেগে শহীদ হয়েছেন আরাফাত। তার মতো হাজারো তেজোদ্দীপ্ত তরুণের ত্যাগ ও সংগ্রামের ফলে সেদিন ১৬ বছরের স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে।
উদ্বিগ্ন মায়ের সতর্ক চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে সাহসিকতার সঙ্গে ঐতিহাসিক জুলাই যুদ্ধে অংশ নিয়ে অমরত্বের খাতায় নাম লেখায় গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের ছোট বনগ্রামের স্বপন মুন্সী ও মায়া বেগমের একমাত্র সন্তান আরাফাত (১৪)।
শহীদ আরাফাতের বাবা পেশায় রিকশাচালক। মা আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার কর্মী হিসেবে চাকরি করতেন। সে সুবাদে আরাফাতও মা-বাবার সঙ্গে আশুলিয়ার নামাবাজার এলাকার ভাড়া বাসায় থাকত। আশুলিয়ার বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল সে।
গত ২০ এপ্রিল গ্রামের বাড়িতে শহীদ আরাফাতের মা মায়া বেগমের সঙ্গে কথা হয় বাসস প্রতিবেদকের। সন্তানের ছবি বুকে জড়িয়ে সেই দিনের কথা স্মরণ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট আমার ছেলে আরাফাত বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে এ ভয়ে আমি সকাল ৭টা বাজলেও ঘরের বাতি জ্বালাইনি।লাইট বন্ধ করে ওকে ঘুমিয়ে রেখেছিলাম। আমিও শুয়ে ছিলাম ওর পাশে।
সকাল ৯টার সময় আরাফাত ঘুম থেকে উঠে বলে—’মা, তুমি আমাকে ডাকনি কেন? দেখ মা, ভয় পেলে হবে না। এখন মেয়েরাও ঘরে বসে নেই, রাস্তায় নেমে এসেছে। আমি ছেলে মানুষ, এ দেশ আমাদের। বাঁচতে হলে যুদ্ধ করতে হবে। মা, আমরা দেশের নাগরিক, দেশে আমাদের অধিকার আছে, দায়িত্ব-কর্তব্যও আছে। আমরা যদি দেশের জন্য যুদ্ধ না করি, তাহলে কি অন্য দেশের ছেলেরা এসে দেশ রক্ষা করবে?’
মায়া বেগম বলেন, ‘আমি বললাম—’না বাজান, তুমি আমার একমাত্র সন্তান। তোমার আন্দোলনে যাওয়ার দরকার নেই। তোমার যদি কিছু হয়ে যায়, আমি কাকে নিয়ে বাঁচব? আমাকে কে ‘মা’ বলে ডাকবে? আমি কারে ‘বাজান’ বলে ডাকব, ভাত খাইয়ে দেব? বাজান, তুমি এখনও ছোট, আগে বড় হও।’ অনেক করে বুঝিয়েছি। পরে এক কাপ চা বানিয়ে দুজনে মিলে ভাগাভাগি করে খাই।
ও যেন বাসা থেকে বের হতে না পারে, সেজন্য আমি দুপুরে একবারে দুবেলার রান্না করে ফেলি। আমার বাজানের তেলাপিয়া মাছ খুব পছন্দ ছিল। তেলাপিয়া আর পুঁইশাকের ঝোল রান্না করি। আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে আরাফাতকে খাওয়ার জন্য ডাকি।
খাবার দিয়ে বলি—’তোকে তাড়াতাড়ি খেতে দিলে তুই বাইরে চলে যেতি বাজান। তোকে দেখতে পাইতাম না।’ আরাফাত বলল—’না মা, এসব ঠিক না, আমি এখন বড় হয়েছি। ক্লাস এইটে পড়ি। আচ্ছা মা, থাক, তুমি যখন বলছ, আমি যাব না।’
এরপর ভাত খেতে দিলে আদুরে গলায় আবদার করে বলে, ‘মা, তুমি আমাকে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিবা? দাও না। তুমি আমার ভালো মা না? তুমি না আমার লক্ষ্মী মা?’ আমার কপালে একটা চুমা দেয়। আমি ওকে এরপর ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিই। খেয়ে সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয় এবং ফোনে ভিডিও দেখে। এর মধ্যে নেটওয়ার্ক চলে যায়।’
আরাফাতের মা আরও বলেন, ‘আরাফাত দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে বাইরে যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করে। আমি যেতে দিইনি। পরে ছাদে যাওয়ার জন্যও আমাকে অনেক পীড়াপীড়ি, অনুনয়-বিনয় শুরু করে। তাও যেতে দিইনি।’
এরপর সে ময়লা ফেলার নাম করে বাইরে যাওয়ার জন্য নানা বাহানা করতে থাকে। বেশ বিরক্ত হয়ে বললাম—’আচ্ছা যাও, কিন্তু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবা। এখন ১২টা বাজে, ১টার মধ্যে চলে আসতে হবে।’ সে বলল—’মা, আমি তো আজ খেলতে যাব না, যুদ্ধে যাব।’ ময়লা ব্যাগে ভরে নিয়ে বাইরে যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।
আমি বলি—’তুই হাসিস কেন? আমার ভয় করে, এমন করে হাসিস না, বাজান।’ তখন সে আমার ভিডিও করে। হাসি-তামাশা করে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার ফাঁকে মুখ রেখে বলে—’মা, আজ দেখ, দেশ স্বাধীন করে ঘরে ফিরব।’
একথায় আমি রেগে গিয়ে বলি—’বান্দির বাচ্চা, দেশ স্বাধীন করে আসবি!’ তখন সে ডাস্টবিনে ময়লা ফেলে এক দৌঁড়ে চলে গেল। আর জিন্দা ফিরল না—ফিরল লাশ হয়ে।
সহপাঠীরাও বারবার বলেছিল—’আরাফাত, বাইরে যেও না। পুলিশ বুলেট ছুঁড়ছে।’ আরাফাত বলেছিল—’যুদ্ধে যাব। ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’—বলে সামনে এগিয়ে যায়। সব বন্ধু ফিরে এলেও, সে আর ফেরেনি। আমি অনেকবার ফোন করেও ফিরিয়ে আনতে পারিনি তাকে।’
আরাফাতের মা মায়া বেগম প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে আরও বলেন, ‘ওর হাতে একটা লাঠি ছিল। যখন সেনাবাহিনীর গাড়ি আসে, তখন গাড়ির ওপরে উঠে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যায় ও। এসময় সামনে থেকে পুলিশের গুলি লাগে।
বিকেল ৩টার দিকে ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলে। আশপাশ থেকে অনেক শব্দ আসছিল। আমি বললাম—’তুই কোথায়? ভাত খাবি না, বাজান?’ আরাফাত বলে—’মা, আমি খেয়েছি। তুমি ভাত খাও, আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি। আমার কিছু হয়নি। ৬টার সময় বাসায় আসব।’ এটাই তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। হয়তো তখনই গুলি লেগেছিল ওর বুকে।
তিনি আরও বলেন, ‘সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে আবার আরাফাতের ফোনে কল দিই। তখন সোহেল নামে এক অচেনা যুবক ফোন ধরে বলে—’আপনি কি আরাফাতের মা?’ এসময় পাশ থেকে একজন বলছিল—’অ্যাম্বুলেন্স আনব?’ শুনে আমি বললাম—’কেনো, অ্যাম্বুলেন্স কেনো?’ বলল—’আরাফাত তো পুলিশের গুলিতে মারা গেছে।’ আমার মাথায় যেন বাজ পড়ে। সেখানেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাই।
পরে ওই যুবকেরা গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় আমাকে। কিন্তু হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মীরা ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। তারা কাপড় দিয়ে ঢাকা আমার ছেলের রক্তাক্ত লাশ নিয়ে আসে। আমি আমার ছেলের পা দেখেই চিনে ফেলি। তারা জানতে চায়—:আপনি লাশ কোথায় নেবেন?’ আমি বলি—’গ্রামের বাড়িতে।’
ওরা সবাই মিলে টাকা তুলে একটি পিকআপ ভাড়া করে লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। পরদিন নিজ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে আমার কলিজার টুকরা বাচ্চাটারে মাটির ভিতরে শুয়াইয়া দেওয়া হয়।
মায়া বেগম বলেন, ‘অনেক অভাব-অনটনের ভেতর দিয়ে গেলেও কখনও ছেলেকে অভাব বুঝতে দিইনি। আমার অনেক স্বপ্ন ছিল—আমার আরাফাত বড় হবে, পড়ালেখা করে সেনাবাহিনীতে চাকরি করবে। কিন্তু ছেলেটাই তো হারিয়ে ফেললাম। এখন আমি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব?’
ছেলে হত্যার বিচার দাবি করে শহীদ আরাফাতের মা বলেন, ‘আমি আমার সন্তানের হত্যার বিচার চাই। খুনিদের বিচার দেখে মরতে চাই।’ আল্লাহ যেন কাউকেই আমার মতো সন্তানহারা না করেন, বলেন তিনি।
আরাফাতকে ‘জুলাই শহীদ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সরকার প্রকাশিত গেজেটে তার ক্রমিক নম্বর—৭৫।
শহীদ আরাফাতের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২ লাখ, জেলা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে ১ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সুত্রঃ বাসস