পার্সেল প্রতারণা: কুলি থেকে কোটিপতি বিপ্লব

বিপ্লব লস্করের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। সেখানে কাজ করতেন। এরপর চলে আসেন ঢাকার মিরপুরে। এখানে এসে ফুটপাতে কাপড় বিক্রি শুরু করেন। সেখানে পরিচয় হয় নাইজেরিয়ান নাগরিকসহ আফ্রিকান কয়েকজন নাগরিকের সাথে। পরবর্তী সময়ে তাদের সঙ্গে যোগসাজস করে গড়ে তোলেন পার্সেল প্রতারণা চক্র। গত কয়েক বছরে বিপ্লব লস্কর কয়েক হাজার মানুষের সাথে পার্সেলের নামে প্রতারণা করেছেন।
শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়নি। সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা অভিযান চালিয়ে বিপ্লব লস্করসহ প্রতারণা চক্রের সঙ্গে জড়িত নাইজেরিয়ান নাগরিকসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। এর মধ্যে পাঁচজন নাইজেরিয়ান আফ্রিকান এবং বাকি ছয়জন বাংলাদেশি।
মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিবির প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. হারুন অর রশিদ।
এই বিপ্লব লস্করকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে খুঁজছে দাবি করে হারুন বলেন, বিপ্লব লস্কর এক সময় কুলি ছিলেন। ঢাকায় এসে একপর্যায়ে পার্সেল প্রতারণাকারী চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ে নিজেই একটি চক্র গড়ে তোলেন। এভাবে গত কয়েক বছরে কয়েক হাজার মানুষের সাথে পার্সেল প্রতারণা করেছেন তারা। সেই চক্রের বাকি সদস্যদের আমরা খুঁজছি। তাদেরও গ্রেফতার করা হবে।
যেভাবে প্রতারণা করা হতো
ডিবির প্রধান হারুন বলেন, বিপ্লব লস্কর প্রতারক চক্রের সদস্যদের দিয়ে ফেসবুক আইডি খুলতেন। ভুয়া ও ফেক আইডি খুলে তাতে তারা আমেরিকান আর্মি ও নেভিতে কাজ করেন এমন ছবি ফেসবুকে প্রোফাইল আইডিতে দিতেন। প্রথমে তারা কাউকে রিকোয়েস্ট পাঠাতেন। এরপর বন্ধুত্ব গড়ে তুলতেন। বন্ধুত্বের একপর্যায়ে সেই ব্যক্তিকে বলা হতো, আমি আফগানিস্তান অথবা অন্য একটি দেশে আছি। এই মুহূর্তে সেখানে যেতে পারছি না। আমার কাছে প্রচুর ডলার ও স্বর্ণালংকার রয়েছে। আমি তোমাকে পাঠিয়ে দিই তুমি তা গ্রহণ করো। এরপর চক্রের সদস্যরা কুরিয়ার করা ডকুমেন্ট হিসেবে একটি কাগজের ছবি তুলে পাঠাতেন সেই ব্যক্তিকে। পরে তারাই আবার কোনো একজন নারী সদস্যকে দিয়ে কর্মকর্তা সেজে সেই ব্যক্তিকে ফোন করাতেন এবং বলতেন, আপনার নামে একটি বিদেশি পার্সেল এসেছে। কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে যে নারী ফোন করেন তার কণ্ঠটা খুব সুন্দর।
ফোনে বলা হয় আপনি দেবেন নাকি সেই বিদেশি বন্ধু দেবে। এরপর সেই ব্যক্তি বলেন, আমি দেবো। এভাবে সেই ব্যক্তির কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আদায় করা হতো। আর এই টাকা নেওয়া হতো একটি অ্যাকাউন্টে।
দুই তিন দিন পর আবার বলা হতো, আপনার পার্সেলে কিছু অবৈধ ডলার রয়েছে। এজন্য মানিলন্ডারিংয়ের মামলা হবে। সাংবাদিক থেকে কাস্টমস কর্মকর্তারা জেনে গেছেন। এগুলো ছাড়াতে ঘুষ দিতে হবে। এজন্য আপনাকে কয়েক লাখ টাকা দিতে হবে। বাধ্য হয়ে সেই ব্যক্তি তাকে আরও টাকা দিতেন। এভাবে বিপ্লব লস্কর বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা আদায় করেছেন।
ডিবি প্রধান বলেন, পার্সেলের নামে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা দেওয়ার জন্য বিপ্লব লস্কর অনেকগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেন। তার এটিএম কার্ড রয়েছে ৪৯১টি এবং চেকের পাতা রয়েছে দেড় হাজারের অধিক। হাজারখানেক ব্যক্তির নামে এই বিপ্লব লস্কর বিভিন্ন ব্যাংকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন। ব্যাংকের চেক বই এটিএম কার্ড এবং ক্রেডিট কার্ড সবটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন বিপ্লব লস্কর নিজে। আমরা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে ক্রেডিট কার্ডের সমস্যা হলে মাসের পর মাস ঝামেলা পোহাতে হয়। কিন্তু বিপ্লব লস্কর খুব সহজে অন্যের পাসপোর্ট দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারতেন, ক্রেডিট নিতেন।
হারুন বলেন, বিপ্লব লস্করের চক্রটি যারা বিভিন্ন মানুষকে বিদেশে পাঠান তাদের কাছ থেকে আসা পাসপোর্টের ছবিও স্ক্যান করে নেওয়া ছবি দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলত। প্রতারক চক্রটি এভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা হাতিয়ে নিতো। এসব টাকার দশ শতাংশ পেতেন বিপ্লব লস্কর। বাকি টাকা প্রতারক চক্রের সদস্যরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতেন। তার সঙ্গে থাকা বিদেশি প্রতারক চক্রের সদস্যরা এই টাকা থেকে পণ্য কিনে তাদের দেশে পাঠিয়ে দিতেন। এভাবে চক্রটি বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে যে নারী কল করতেন তাকে একটি টাকার অংশ দেওয়া হতো।