এখনও থামেনি শহীদ রাসেলের মায়ের বুক ফাটা কান্না

রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে এক নারীর প্রতিটি ভোরই শুরু হয় বুক ফাটা কান্নায়। তাঁর নাম সাফুরা বেগম—শহীদ রাসেলের মা। প্রিয় ছেলেকে হারিয়ে তাঁর কাছে জীবন যেন অর্থহীন এক ভার।
দেশে দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটায় যে ছাত্র-আন্দোলন, তার এক সাহসী যোদ্ধা ছিল রাসেল। নির্ভীক হৃদয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে জনগণের কাতারে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
কিন্তু বিজয়ের সকাল আর দেখে যেতে পারেনি সে—কাজলা ফুটওভার ব্রিজের কাছে পুলিশের গুলিতে থেমে যায় রাসেলের জীবন। দেশের ইতিহাসে শহীদের তালিকায় যুক্ত হয় আরেকটি নাম—শহীদ রাসেল।
২৯ বছর বয়সী ছোট মাছ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রাসেল ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ঐতিহাসিক ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে শহীদ হন।
আন্দোলনে ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে সফল হলেও, রাসেল নিজ চোখে সেই বিজয় দেখে যেতে পারেননি।
বিধবা মা সফুরা বেগমের সেবাযত্নকারী এই প্রিয় সন্তানটিকে ঢাকার যাত্রাবাড়ীর কাজলা ফুটওভার ব্রিজের কাছে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার সময় গুলি করে হত্যা করা হয়।
‘আমি মারা গেলে আম্মুর খেয়াল রাখিস’— আন্দোলনের কয়েকদিন আগে ভাইকে এমন কথাই বলেছিলেন রাসেল, যেন বুঝেই নিয়েছিলেন আন্দোলনের রাস্তায় শহীদ হওয়া তার জন্য অবধারিত।
যাত্রাবাড়ীর শানির আখড়ায় তাদের বাড়িতে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় রাসেলের মা সফুরা বেগম বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেই কথাগুলো এখন তার পরিবারকে তাড়া করে ফেরে।
‘এক মুহূর্তও আমার ছেলে রাসেলকে ভুলতে পারি না… খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না’— বললেন সফুরা বেগম, যার চোখের জল যেন শুকায় না।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই সফুরা বেগম ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছেন, আর্থিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন রাসেলের ওপর।
ছয় ভাইয়ের মধ্যে রাসেল ছিলেন তৃতীয়। বড় ভাই মোহাম্মদ মনির (৩৫) ও ছোট ভাই মোহাম্মদ রানা (১৮) প্রাইভেট কার চালক; মোহাম্মদ রুবেল (৩০) মোবাইল মেকানিক; মোহাম্মদ সোহেল (২২) ও মোহাম্মদ জুয়েল (২০) মাছ বিক্রেতা।
সবাই মিলেই চলছিল সংসার, সক্রিয়ভাবে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে কাজ করছিলেন তারা। তবে রাসেলের শূন্যতা পূরণ করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
‘৪ আগস্ট আমরা নিজের চোখে দেখেছি কাজলা ফুটওভার ব্রিজের কাছে একজন বয়স্ক মানুষ আর এক কিশোরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমরা ওদের দেহ হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওরা আগেই মারা গিয়েছিল,’— স্মরণ করলেন রাসেলের বড় ভাই রুবেল।
সেদিন বিকেল ৫টার দিকে বাসায় ফিরে রুবেল ভাইদের সতর্ক করেছিলেন— যেন আর কেউ ওই ব্রিজের কাছে না যায়।
কিন্তু পরদিন, ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রাসেল ও তার ভাইয়েরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিছিল নিয়ে যাত্রাবাড়ী দিকে এগিয়ে যান।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কাজলা ফুটওভার ব্রিজে পৌঁছলে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। সাত-আটটি গুলি চলার পর পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন— রাসেল তাদের একজন।
রাসেলের ভাই রুবেল জানান, নিহতদের মধ্যে একজন নারী ও একজন মাদ্রাসাছাত্রও ছিলেন।
‘আমরা রাসেলের মরদেহ উদ্ধারও করতে পারিনি, কারণ পুলিশ তখনো গুলি চালাচ্ছিল। দশ মিনিট পর প্রচণ্ড বৃষ্টি নামলেও গুলিবর্ষণ থামেনি। শেষ পর্যন্ত আমাদের এক পরিচিত জন, সোহেল নামের একজন, রাসেলের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে সমর্থ হন,’ বলেন রুবেল।
পরে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের হাতে রাসেলের মরদেহ হস্তান্তর করা হয় এবং তাকে মাতুয়াইল কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তবে সফুরা বেগমের জীবনে যেন সময় থেমে গেছে সেদিন থেকে। ছেলের অনুপস্থিতি তার হৃদয়ে এমন এক ক্ষত হয়ে আছে, যা কোনো দিনই সারবে না।
‘রাসেল ছিল স্নেহশীল আর যত্নবান। আমার পাঁচ ছেলে থাকলেও ওর পাশে আমি নিজেকে নিরাপদ মনে করতাম। এখন মনে হয়, আমি যন্ত্রণায় মরছি,’— কাঁপা গলায় বলেন সফুরা।
পটুয়াখালীর গলাচিপার এই পরিবারটি এখন চায় ন্যায়বিচার। রাসেলের ভাই রুবেল ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদেরকে প্রধান অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
তাদের দাবি, রাসেল ও আরও অনেক শহীদের হত্যার বিচার হোক।
‘ঢাকামুখী পদযাত্রা’ স্বৈরাচার পতনে সফল হলেও রাসেলদের পরিবারের জন্য এর মূল্য ছিল অকল্পনীয়। আর সফুরা বেগমের জন্য— কোনো রাজনৈতিক বিজয়ই তার ছেলের মৃত্যুজনিত শূন্যতা পূরণ করতে পারে না। সুত্রঃ বাসস