ফসল আর সবজির উৎপাদন বাড়াতে মাঠে ঘাটে ছুটে বেড়ান কৃষি অফিসার সুবর্ণা ইয়াসমিন সুমি
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলা পরিকল্পিতভাবে বারো মাস বিভিন্ন ধরনের ফসল, ফল, সবজি উৎপাদন করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে এ উপজেলা দেশের কৃষি সমৃদ্ধ মডেল উপজেলা হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। আর এই সাফল্য,পরিচিতি এসেছে একজন কৃষি কর্মকতার হাত ধরে।
তিনি এই উপজেলার কৃষি কর্মকতা সুর্বনা ইয়াসমিন সুমি। একজন নারী কর্মকতা হয়েও ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত বিশাল এ উপজেলার ফসলের মাঠ থেকে কৃষক কৃষাণীর বাড়ির আঙ্গিনার উঠান পর্যন্ত প্রতি নিয়তে তার অবাধ বিচরন তার। কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সহ এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সেজন্য কৃষক-কৃষাণীদের বারো মাস নানা রকম ফসল,ফল,সবজি চাষাবাদে সচেতন ও তাগাদা দিচ্ছেন ।
একই সাথে এসবের অবস্থা দেখে দিচ্ছেন সার,বালাইনাশকের ব্যবহার সহ প্রয়োজনীয় সব রকম পরার্মশ। এজন্য তিনি উপজেলার কৃষক-কৃষাণীদের কাছে কর্মকতা নয়,কৃষক বন্ধু হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। তার হাত ধরেই এ উপজেলার কৃষি উৎপাদন এখন সারা দেশে একটার পর একটা রেকর্ড অতিক্রম করে চলেছে। সাফল্যের সেই সংবাদ প্রতিনিয়তো উঠে আসছে দেশের শীর্ষস্থানীয় টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায়।
উল্লাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকতা হিসাবে সুবর্ণা ইয়াসমিন সুমি যোগদানের পর উপ-সহকারী কৃষি কর্মকতাদের নিয়ে একটি শক্তিশালী টিম তৈরি করেন। তাদের সাথে নিয়ে তিনি এ উপজেলার কৃষি ও কৃষককে চাষাবাদের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাভলম্বী করতে পরিকল্পনা তৈরি করেন। সে মোতাবেক শুরু হয় তার বাস্তবায়ন। এ কর্মকতার দক্ষ নেতৃত্বে চলতি বছরে সারা বাংলাদেশে উল্লাপাড়া উপজেলা সরিষা উৎপাদনে প্রথম স্থান অধিকার করে তাক লাগিয়ে দেয়। শুধু সরিষা উৎপাদন নয়।
এ উপজেলা সরিষা ফুল থেকে মৌমাছি দিয়ে মধু আহরণেও শীর্ষে। উপজেলার ১১০ জন মৌ খামারীকে মধু আহরণের প্রশিক্ষণ সহ সার্বিক সহযোগীতা দেয়া হয়। এই সহযোগীতা পেয়ে তারা উপজেলার বিভিন্ন সরিষা মাঠে মৌ-বক্স বসিয়ে ১শ’৬৮ টন সাদা সোনা খ্যাত মধু আহরণ করেছে। যার বাজার মূল্যে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। এই মধু আহরনে সময় মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়নের ফলে সরিষার উৎপান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যা দেশে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। উল্লাপাড়া উপজেলা এক সময় মৌসুমী এবং শীতকালীন সবজি চাষাবাদে অনেক পিছিয়ে ছিল।
এ কর্মকতা যোগদানের পর গত তিন বছরে উপজেলার প্রতিটি এলাকায় কৃষকদের প্রশিক্ষন,উঠান বৈঠক,উপকরণ দেয়া সহ সচেতন করে দক্ষ সবজি চাষী তৈরি করেছেন। বারো মাসী,মৌসুমী মিলে এ উপজেলায় এখন সবজি চাষী ২৯ হাজার ৪শ’জন। তারা বছরে শুধু সবজি চাষাবাদ থেকেই প্রায় ২শ’১০ কোটি টাকা আয় করছে। যা উপজেলার চাষীদের অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছলতা এনে দিয়েছে।
জমিতে রাসায়নিক সারের পরির্বতে কৃষকদের বাড়িতেই সহজ পদ্ধতিতে জৈব সার তৈরি করে ব্যবহার বাড়াতেও এই কৃষি কর্মকতা অনেক ভূমিকা রেখে চলেছেন। কৃষকরা উৎসাহিত হয়ে এখন ফসল ও সবজি চাষাবাদে নিজেদের তৈরি জৈব সার ব্যবহার করছে। তার তদারকিতে প্রকল্পের আওতায় উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বসত বাড়ির আঙ্গিনায় পরিত্যক্ত পতিত জমিতে ইতোমধ্যে প্রায় ১ হাজার পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপিত হয়েছে। যেখানে কৃষক কৃষানীরা বারো মাস হরেক রকম সবজি ফলিয়ে নিজেরা খাচ্ছে। নিজ পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পুরনের পাশাপাশি এখানকার উৎপাদিত সবজি বিক্রি করে তারা এখন বাড়তি আয়ও করছে।
এছাড়াও এই কর্মকতার সহযোগীতায় জেলায় প্রথম উল্লাপাড়ার মাটিতে কৃষকরা উচ্চমূল্যের অর্থকারী ফসল চিয়াসীড চাষাবাদে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। চলতি বছর উপজেলার কয়ড়া এলাকায় প্রায় ৯০ বিঘা চমিতে চিয়াসীড চাষাবাদ হয়। যার বাম্পার ফলনে লাভবান হয়েছে কৃষকরা।
এছাড়াও কৃষকদের ট্রেনিং ও উৎসাহ দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন বানিজ্যিকভাবে উচ্চমূল্যের ফল ড্রাগন,ষ্ট্রবেরী,মালটা,লেবু চাষাবাদ করাচ্ছেন। এ চাষবাদের মাধ্যমেও কৃষকরা ভাল টাকা আয় করছেন। মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের পাশে থেকে ফল চাষাবাদে সব সময় উৎসাহ,অনুপ্রেরনা,সহযোগীতা দিচ্ছেন কৃষি কর্মকতা সুর্বনা ইয়াসমিন সুমি।
এর বাইরেও উপজেলার বিভিন্ন এলাকার উচুঁ,নিচু,পরিত্যক্ত জমির তালিকা করে সেসব এলাকায় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকতাদের সাথে নিয়ে কৃষকদের বাড়িতে উঠান বৈঠক দিচ্ছেন। কৃষকদের এসব জমিতে কি ধরনের ফসল,সবজি,ফল চাষাবাদ করা যায় তার পরার্মশ সহ প্রনোদনার মাধ্যমে সার,বীজ দিয়ে অনাবাদি জমি চাষাবাদের আওতায় আনছেন। এতে প্রতি নিয়তো উপজেলার কৃষি উৎপাদন বেড়ে চলেছে।
সারা দেশের কৃষি কর্মকতাদের সরকারী গাড়ী রয়েছে। কিন্তু কৃষি সমৃদ্ধ বৃহৎ এ উপজেলা কৃষি কর্মকতার কোন সরকারী গাড়ী নেই। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কৃষি কর্মকতা সুর্বনা ইয়াসমিন কখনো পায়ে হেটে, ভ্যান-রিক্সা,সিএনজি চালিত অটোরিক্সায় মাইলের পর মাইল পথ ছুটে চলেন মাঠে-ঘাটে। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকতাদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহে একদিন মিটিং করেন।
এখানে ঠিক করেন পুরো সপ্তাহের কর্ম পরিকল্পনা। অফিসের কাজ সেরে ছুটির দিন সহ প্রতিদিন তিনি রুটিন মাফিক মাঠে বের হন মাঠে। তদরকি করেন সার্বিক চাষাবাদ সহ মাঠ কর্মীদের কার্যক্রম। প্রায়ই তিনি নিজেই কৃষকদের সাথে নেমে পড়েন চাষের জমি কিংবা কাঁদায়। কৃষকদের সাথে হাত মিলিয়ে মাঠে কাজ করে বুঝিয়ে দেন সবকিছু।
প্রতিদিন তার সাথে কৃষকের দেখা হয় কোন না কোন ফসলের মাঠে কিংবা বাড়িতে। নম্র,ভদ্র আচরন আর সদা হাস্যউজ্জল এ কর্মকতা উপজেলার কৃষক-কৃষাণীর আপন মানুষে পরিণত হয়েছেন। তাদের কাছে অনুপ্রেরনার বাতিঘর তিনি। এ উপজেলার কৃষিতে এমন সাফল্যর কারনে প্রতি নিয়তো কৃষি মন্ত্রনালয় কিংবা অধিদপ্তরের যে কোন পরির্দশ টিম আসে এখানে। সবাই এ উপজেলার কৃষি কর্মকতার মাঠ পর্যায়ের এমন কর্মকান্ড নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এই কর্মকতার উৎসাহ অনুপ্রেরনায় উল্লাপাড়ার কৃষির এমন ঈর্শানীয় সাফল্যের সংবাদ প্রতিনিয়তো উঠে আসছে দেশের বিভিন্ন জনপ্রিয় টেলিভিশন এবং জাতীয়,স্থানীয় পত্রিকায়।
উল্লাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকতা সুবর্ণা ইয়াসমিন সুমি দৈনিক কালবেলাকে জানান,আমি কৃষি,কৃষক আর মাটিকে প্রচন্ড ভালবাসি। মাটির টানে কৃষক-কৃষানীর ভালবাসায় মাঠে ঘাটে ছুটে বেড়াই। অফিসের জরুরী কাজ সেরে নিয়ম করে ছুটির দিন সহ প্রতিদিন মাঠে বের হই। একেক দিন একেক এলাকায় যাই। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকতাদের সাথে নিয়ে উপজেলার প্রতিটি ব্লকের পাড়া মহল্লায় উঠান বৈঠক করি।
কৃষক-কৃষাণীদের সাথে কথা বলি। তাদের মাঠের ফসল দেখে পরার্মশ দেই। কোন জমিতে কি চাষাবাদ করলে তারা লাভবান হবে তা বুঝাই। অনাবদি পতিত জমির মাটি দেখে ফসল চাষাবাদের তাগিদ দেই। যখন মাঠে ঘাটে যাই কৃষক কৃষানীদের অকৃত্রিম ভালবাসা আমাকে মুগ্ধ করে। তখন সব কষ্ট ভুলে যাই। আমার উর্ধ্বতন কর্মকতাগণ সব সময় সার্বিক সহযোগী করেন বলেই আমি এসব করতে পারি।