মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে এসেছি : জুলাই বিপ্লবে হাত হারানো মঞ্জয় মল্লিক

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে ডান হাত হারিয়েছেন সাভার প্রেসক্লাবের অফিস সহকারী মঞ্জয় মল্লিক (১৮)। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে মঞ্জয় মল্লিক বলেন, ওইদিন মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখে এসেছি আমি। এখনও ভুলতে পারি না সেদিনের কথা। এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়লেই আতঁকে উঠি।
মঞ্জয় মল্লিক সাভার থানা রোডের একটি বাড়িতে মায়ের সাথেই থাকেন। বাবা মন্টু মল্লিক বেশ কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েেেছন। তার মা সাভার সরকারি কলেজের ঝাড়ুদারের কাজ করেন। অভাবের সংসার। তাই পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে এক বছরানেক আগে সাভার প্রেসক্লাবে অফিস সহকারী হিসেবে যোগ দেন তিনি।
মঞ্জয় মল্লিক বাসসকে জানান, ‘অন্যান্য দিনের মতোই ৫ আগস্টও সাভার প্রেসক্লাবে এসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছিলাম। বাইরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎই লোকজনের হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে ক্লাবের বাইরে বেরিয়ে দেখি, অনেক লোকজন থানা রোড দিয়ে মিছিল নিয়ে থানার দিকে আসছে। এমন অবস্থায় আমি দ্রুত ক্লাবে তালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাই।’
তিনি বলেন, ‘সামনে মিছিল দেখে আমি দৌড়ে বিপরীত দিকে অর্থাৎ উল্টো থানার দিকে যেতে থাকি। থানা রোডে যখন সাভার অধরচন্দ্র সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় অতিক্রম করি তখন দেখি সামনের দিক দিয়ে পুলিশ মিছিলটি লক্ষ্য করে গুলি করতে করতে আসছে। তখন দুপুর প্রায় ২টা বাজে।’
মঞ্জয় বলেন, ‘পুলিশ আসছে দেখে আমি পাশেই একটি ফাঁকা স্থানে লুকিয়ে পড়ি। তখন পুলিশের এক সদস্য আমাকে গুলি করতে উদ্যত হলে আমি তাদেরকে আমার পরিচয় দিয়ে বলি আমি প্রেসক্লাবের পিয়ন, আমাকে মারবেন না, আমাকে ছেড়ে দেন।’
তিনি বলেন, ‘এসময় পাশে থাকা অন্য আরেক পুলিশ সদস্য এসে খুব কাছ থেকে আমার ডান হাত লক্ষ্য করে গুলি করে। এছাড়া ছররা গুলিও করে যা আমার পেটে বিদ্ধ হয়। তখন আমার হাতের কোন বোধ শক্তি ছিল না। চোখে-মুখে অন্ধকার দেখতে থাকি।’
তিনি আরও বলে, ‘আমি ওই অবস্থায়ই এক হাত দিয়ে অন্য হাত ধরে দৌড়ে দৌড়ে সাভার সরকারি হাসপাতালের দিকে যাই। প্রচুর রক্তক্ষরণে এসময় আমি একবার অজ্ঞান হয়ে পড়ি। এর কিছুক্ষণ পর সাভার সরকারি হাসাপাতাল থেকে আমার হাত ব্যান্ডেজ করে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা হলেও আমি আর হাত নাড়াচাড়া করতে পারছিলাম না।’
মঞ্জয় বলেন, ‘পরবর্তীতে বিকেলে দু’জন ব্যক্তি আমাকে ধরে দ্রুত সাভার সরকারি হাসপাতাল থেকে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে আমার মাসহ অন্যরা হাসপাতালে ছুটে আসে।’
তখন আমার জ্ঞান থাকলেও আমি কোন কথা বলতে পারছিলাম না। এসময় আমার মায়ের সাথে ডাক্তাররা বলছিল ওর হাতের অবস্থা ভালো না, ওর হাত কেটে ফেলতে হবে। এরপর আর আমার জ্ঞান ছিল না। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি, আমার একটি হাত নেই।’ বলেই কেদেঁ ফেলেন মঞ্জয়।
মঞ্জয় মল্লিক বলেন, এমনিতেই আমাদের অভাবের সংসার। হাত হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করায় পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি থেকে বোঝায় পরিণত হয়েছি। এমন অবস্থায় বাকিটা জীবন কীভাবে কাটবে তা নিয়ে চিন্তায় আছি। এখন পর্যন্ত কেউ কেউ কিছুটা সাহায্য করলেও তা যৎসামান্য।
সংশ্লিষ্টদের কাছে জমি কিনে থাকার একটি জায়গার পাশাপাশি জীবন-জীবিকার জন্য স্থায়ী একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
মঞ্জয় মল্লিকের মা জোৎস্না মল্লিক বাসসকে বলেন, আমার একটি মাত্রই ছেলে। স্বামীকে হারিয়ে এ ছেলেকে নিয়েই ছিল আমার সব স্বপ্ন। গুলিতে হাত হারিয়ে আজ সব স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। কীভাবে আমার ছেলেটি বাকিটা জীবন কাটাবে।
গুলি ছোড়া সেইসব ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবির পাশাপাশি ছেলের ভবিষ্যতের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা চান তিনি।
সাভার প্রেসক্লাবের সভাপতি নাজমুস সাকীব ও সিনিয়র সহ-সভাপতি আরিফুর রহমান বাসসকে বলেন, ‘মঞ্জয় মল্লিকের গুলিবিদ্ধের খবর পেয়ে আমরা প্রেসক্লাবের নেতৃবৃন্দ দ্রুত হাসপাতালে ছুটে যাই। ওর চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেই।’
মঞ্জয়ের গুলিবিদ্ধের ঘটনায় সবাই মর্মাহত উল্লেখ করপ তারা বলেন, ‘ওর একটি হাত হারিয়েছে। সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে।’ সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে এসময় প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে যথা সম্ভব সহযোগিতারও আশ্বাস দেন তারা।
তারা জানান, হাসপাতালে ওর চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক কিছু অনুদানের ব্যবস্থাও করা হয়েছে বলেও জানান তারা।
তারা বলেন, ‘ওর একটি কৃত্রিম হাতেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে যা খুব শীঘ্রই প্রতিস্থাপন করা হবে। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি অনুদানের জন্যও চেষ্টা করা হচ্ছে। বাকিটা জীবন যেন ও চলতে পারে তার জন্য আমাদের প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার আমরা তাই করব।’ সুত্রঃ বাসস