স্মার্টস্ক্রিনে বন্দী জীবন, মানুষ হারাচ্ছে মানুষকে

এক সময় বিকেল মানে ছিল মাঠে দৌড়, হাসির হুল্লোড়, গায়ে মাটির গন্ধ। এখন বিকেল মানে চার্জার খোঁজা, নোটিফিকেশনের শব্দে চমকে ওঠা আর স্ক্রিনের নীল আলোয় নিজেকে হারিয়ে ফেলা।
একটি ঘরে একসাথে বসে থাকা চারজন মানুষ—প্রতিটিই আলাদা দুনিয়ার বাসিন্দা। চোখে চোখ পড়ে না, শব্দ গুলে যায় নিঃশব্দতায়।
সম্পর্কের রক্তস্রোত এখন থেমে থাকে ওয়াই-ফাই না থাকলে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের ২০২৪ সালের তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ১৩ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, যার ৯০ শতাংশ-এর হাতেই স্মার্টফোন।
সাধারণ ব্যবহার নয়, এটা রীতিমতো এক ডিজিটাল আসক্তি—MindWell Research-এর এক জরিপ বলছে, ২৫ বছরের নিচের তরুণদের ৬৪ শতাংশ একাকীত্ব, বিষণ্নতা কিংবা আত্মসম্মানহীনতায় ভুগছে। অথচ তাদের ‘বন্ধু’র তালিকায় শত শত নাম, হাজার হাজার রিঅ্যাকশন।
এই ভার্চুয়াল ভিড়ে মানুষ হারাচ্ছে মানুষকে।
ভালোবাসা এখন দেখা যায় ‘Seen’ হয়ে যাওয়া মেসেজে, অভিমান বোঝা যায় একঘেয়েমি স্ট্যাটাসে।
বন্ধুত্ব মানে এখন কেউ একজন ‘লাস্ট সিন’ না করে চলে গেছে, মানে সে আর আগের মতো নেই।
দুঃখ হচ্ছে—কিন্তু তা বলা হয় না, লেখা হয় ‘Feeling Sad’ দিয়ে।
প্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে গতি, দিয়েছে জ্ঞান, দিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে দূরের খবর জানার সুযোগ।
কিন্তু সে সঙ্গে কেড়ে নিয়েছে ধৈর্য, কেড়ে নিয়েছে বাস্তব মুখোমুখি যোগাযোগের উষ্ণতা।
একসময় মানুষ মানুষকে জানত শব্দে, স্পর্শে, চোখে চোখ রেখে; এখন জানে প্রোফাইল পিকচার, স্টোরি আর রিল দেখে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ মনে করিয়ে দেয়—প্রযুক্তি সহযাত্রী হতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের দিশারি হতে পারে না।
তাই দরকার একটু সংযম, সামান্য সচেতনতা।
একটু ফোন নামিয়ে পাশে বসা মানুষটার চোখে তাকানো, প্রতিদিনের একটুখানি সময় রাখার চেষ্টা, আর স্ক্রিনের বাইরে যে একটা জগৎ আছে—সেখানে নিয়মিত ফিরে যাওয়া।
সম্পর্কগুলো ব্যাটারিচালিত নয়, এগুলো হৃদয় দিয়ে চলে।
আর হৃদয় কেবল তখনই ধ্বনিত হয়, যখন কেউ সত্যিই পাশে থাকে—স্মার্টফোন নয়, স্পর্শে।