সুরের মূর্ছনায় রুনা লায়লা জয় করেছেন গোটা উপমহাদেশ

তখনও বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। ঢাকার ওল্ড বয়েজ এসোসিয়েশন একটি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সবকিছুই ঠিক ছিল। বিপত্তিটা বাঁধল অনুষ্ঠান শুরুর একটু আগে। খবর এলো, যে কণ্ঠশিল্পীর গান গাওয়ার কথা তিনি অসুস্থ। আসতে পারবেন না। আয়োজকদেরতো মাথায় হাত! পরিস্থিতির কবল থেকে রক্ষা পেতে ছয় বছরের এক বাচ্চাকে ঠেলে দেওয়া হলো মঞ্চে। তবুও আয়োজকদের চিন্তা কাটে না। মেয়েটি কি পারবে এ যাত্রায় তাদের রক্ষা করতে?
একরত্তি মেয়েটি ততক্ষণে তানপুরায় সুর তুলেছে, কণ্ঠে মেলে ধরেছে ক্লাসিক্যাল রাগ। আয়োজকরা খেয়াল করলেন, তার কণ্ঠের যাদুতে বুঁদ হয়ে গেছেন সবাই। দর্শক সারিতে নেমে এসেছে পিনপতন নীরবতা। গান শেষ হতেই করতালিতে ভরে গেল হল। জানা গেল, মেয়েটি ওই অসুস্থ কণ্ঠশিল্পীর ছোট বোন। তিনি কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা । স্রষ্টা যাকে দিয়েছেন কণ্ঠ দিয়ে একটি নয়, দুটি নয় তিন তিনটি ভূখন্ড শাসন করার ক্ষমতা।
বাবা সরকারি চাকুরে হওয়ায় রুনা লায়লা বেড়ে উঠেছেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। সংগীতের সঙ্গে তার সখ্যতা ছোটবেলা থেকেই। গানের শিক্ষক বড়বোন দীনা লায়লাকে গান শেখাতে এলে ছোট রুনাও পাশে বসে সারগাম তুলতেন। তার সেই সারগাম শুনেই বড়বোনের গানের শিক্ষক তার বাবা-মাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন মেয়েকে গান শেখানোর। এভাবেই সংগীতের সঙ্গে পথচলা শুরু তার।
মাত্র ১২ বছর বয়সে পাকিস্তানের ‘জুগনু’ সিনেমার একটি গানে কণ্ঠ দেওয়ার মাধ্যমে পেশাদার সংগীতশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করেন তিনি। ওই অল্প বয়সেই তার কণ্ঠে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সংগীতজ্ঞরা। ফলস্বরূপ সিনেমার গানে নিয়মিত হন তিনি। অল্প সময়েই পশ্চিম পাকিস্তানের শ্রোতাপ্রিয় গায়িকায় পরিণত হন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় রুনা লায়লা যখন বাংলাদেশে ফিরে আসেন তখন পাকিস্তানে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছিলেন তিনি। দেশটির সরকারও তাকে ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু নাড়ির টান পেয়ে বসেছিল তাকে। জনপ্রিয়তা, ক্যারিয়ার, সম্মান— সব তুচ্ছ করে ফিরে আসেন প্রিয় মাতৃভূমিতে।
বাংলাদেশে এসে সংগীতে পথচলাটা তিনি শুরু করেন সংগীত পরিচালক সত্য সাহার হাত ধরে। এরপরের গল্প শুধু জয়ের আর অর্জনের। সে গল্প সবার জানা। ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’ থেকে শুরু করে ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’— সর্বত্র সুরের মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেছেন তিনি।
পৃথিবীর এমন কোনো বড় শহর নেই যেখানে রুনা লায়লা তার সুরের দ্বীপ জ্বলেননি। বাংলা, উর্দু, হিন্দিসহ ১৮ টি ভাষায় ১০ হাজারেরও অধিক গান করেছেন তিনি। তার গান শুনে ঘোর সমালোচকও হয়ে গেছেন তার ভক্ত। এমন একটি ঘটনা ভারতে ঘটেছিল। তৎকালীন ভারতের ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়ার সম্পাদক খুশবন্ত সিং ছিলেন রুনা লায়লার ঘোর সমালোচক। সমালোচনা করতে মুখিয়ে থাকতেন তিনি। এই উদ্দেশ্যেই একবার গিয়েছিলেন রুনা লায়লার গান শুনতে।
সম্পাদক মহাশয় সেদিন রুনা লায়লার গান ও নাচে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে পরদিন তার কাগজ ভরিয়ে দেন রুনা লায়লার স্তুতিবাক্যে। তিনি লিখেছিলেন, ‘রুনাকে দিয়ে দাও, বিনিময়ে ফারাক্কার সব পানি নিয়ে যাও।’ খুশবন্ত সিংয়ের এই লাইনই বলে দেয় কি অপার মুগ্ধতা জড়িয়ে আছে রুনা লায়লার কণ্ঠে। আজ ১৭ নভেম্বর এই কিংবদন্তি গায়িকার জন্মদিন। সত্তর ছুঁয়ে দিল তাকে। জন্মদিন উপলক্ষে এই কিংবদন্তির প্রতি রইল শুভকামনা।