আ.লীগ নেতারা পেলেন ঢাকার সব পশুর হাটের ইজারা
কোরবানির ঈদ সামনে রেখে রাজধানীতে অস্থায়ী ১৭টি পশুর হাট বসাচ্ছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ইতোমধ্যেই ১৫টি হাটের ইজারা চূড়ান্ত হয়েছে। এবারও হাটগুলো সিন্ডিকেটের দখলে। সব হাটের ইজারা পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে হয় ইজারা; তবুও তাদের বাইরে কেউ দরপত্র কেনার সাহসও দেখান না। দুই দফা দরপত্র বিক্রি করেও নতুন মুখের দেখা মেলেনি। অভিযোগ রয়েছে, ইজারা প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ায় রাজস্ব কমছে সিটি করপোরেশনের। তবে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দলীয় পরিচয় দেখে কাউকে হাট ইজারা দেওয়া হয় না।
দুই সিটির রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় অস্থায়ী পশুর হাট বসবে ৯টি। আর উত্তর সিটিতে অস্থায়ী হাট ৮টি। উত্তরে গাবতলী এবং দক্ষিণে সারুলিয়ায় রয়েছে স্থায়ী হাট। দক্ষিণ সিটির অস্থায়ী শাহজাহানপুর ও কমলাপুর পশুর হাটের ইজারা চূড়ান্ত হয়নি। নতুন ইজারাদারদের দরপত্র ফেলতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ১৮ জুনের মধ্যে দুটি হাটের ইজারা চূড়ান্ত হওয়ার কথা। ইজারা হলেও উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ বহাল থাকার কারণে এবার আফতাবনগরে পশুর হাট বসতে পারবে না।
দরপত্রে অংশগ্রহণকারীরা বলছেন, ইজারার ক্ষেত্রে সব সময়ই রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়। যেসব এলাকায় হাট বসানো হয়, সেখানে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকে। চাইলেই যে কেউ হাট সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেন না। এর আগেও ক্ষমতাসীনরাই পশুর হাট নিয়ন্ত্রণ করতেন।
দক্ষিণ সিটিতে গত বছর ১১টি ও এর আগের বছর হাট বসেছিল ১৪টি। যানজট বিবেচনায় এবার অস্থায়ী হাট কমানো হয়েছে। সংসদীয় আসনপ্রতি একটি করে অস্থায়ী হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। প্রথমে আটটি অস্থায়ী হাট এবং পরে উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় আরও একটি হাটের ইজারা বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। গত বছর পশুর হাট থেকে ২১ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার ৫৫৫ টাকা রাজস্ব আদায় হয়। এ বছর ২৫ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য স্থির করেছে ডিএসসিসি।
দক্ষিণ সিটিতে ইজারাপ্রাপ্তদের তালিকায় দেখা গেছে, ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে সোলায়মান সেলিম চতুর্থবারের মতো লালবাগ রহমতগঞ্জ ক্লাব পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন। নির্ধারিত দর ৩৯ লাখ ৩২ হাজার টাকার বিপরীতে তিনি ইজারা পেয়েছেন ৫৬ লাখ ১৫ হাজার টাকায়।
হাজারীবাগের ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজ মাঠে হাটের ইজারা পেয়েছেন ওয়াহিদুর রহমান ওয়াকিব। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। গত বছরও তিনিই পেয়েছিলেন ইজারা।
মেরাদিয়া বাজার সংলগ্ন হাটের ইজারা পেয়েছেন খিলগাঁও থানা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য আওরঙ্গজেব টিটু। প্রথম দফায় ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় ইজারা নেন তিনি। টিটু ছাড়া এ হাটের জন্য মাত্র একটি দরপত্র জমা পড়েছিল। দ্বিতীয় দফায় আগের মূল্যের চেয়ে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা বেশি দিয়ে ৩ কোটি ১ লাখ টাকায় ইজারা নেন টিটু। ৫০ লাখ টাকায় ডেমরার আমুলিয়া মডেল টাউনের আশপাশের খালি জায়গার ইজারা পান ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা সালাউদ্দিন আহমেদের বড় ভাই জসিম উদ্দিন। ৪ কোটি ৭১ লাখ টাকায় যাত্রাবাড়ীর দনিয়া কলেজ সংলগ্ন পশুর হাট ইজারা পেয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মো. কামরুজ্জামান।
সমালোচনা এড়াতে ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল ও পোস্তগোলা শ্মশানঘাট হাটের ইজারাদার পরিবর্তন হলেও আগের সিন্ডিকেটই ইজারা পেয়েছে। ২ কোটি ৬৪ লাখ ৮০ হাজার টাকায় ধোলাইখাল হাটের ইজারা পেয়েছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান ইরান। প্রথম দফায় তিনি ছাড়া আর কেউ হাটের জন্য দরপত্র জমা দেননি। দ্বিতীয় পর্যায়ে দরপত্রে ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বেশি মূল্যে ৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকায় পেয়েছেন মোহাম্মদ হোসেন। পোস্তগোলা শ্মশানঘাটসহ আশপাশের খালি জায়গায় সপ্তমবারের মতো পশুর হাটের ইজারা পান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি মঈন উদ্দিন চিশতী। দ্বিতীয় পর্যায়ে দরপত্রে ১১ লাখ টাকা বেশি মূল্যে ২ কোটি ৮১ লাখ টাকায় শাহনুর রহমান ইজারা নেন।
দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, সর্বোচ্চ দরদাতাকেই ইজারা দেওয়া হয়। এখানে কার কী রাজনৈতিক পদবি তা দেখা হয় না। শাহজাহানপুর ও কমলাপুর অস্থায়ী হাটের ইজারা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। বাকি ৭টি হাটে ইজারাপ্রাপ্তরা চূড়ান্ত নোটিশ পেয়েছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে দরপত্র আহ্বান করায় পাঁচটি হাটে আগের চেয়ে আরও ৫ কোটি টাকা বেশি মূল্য উঠেছে।
ঢাকা উত্তর সিটির অস্থায়ী হাটগুলোর বেশিরভাগ ইজারাদার পুরোনো। ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকায় ভাটারা সাঈদনগর পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন ৪০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। ৬ কোটি টাকা ইজারামূল্যে উত্তরা দিয়াবাড়ী ১৬ ও ১৮ নম্বর সেক্টরের পশুর হাট পেয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য মহিবুল হাসান। ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকায় মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গা পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন কামাল হোসেন। তিনি সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ২ কোটি ২০ লাখ টাকায় মোহাম্মদপুর বসিলার ৪০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন খালি জায়গার ইজারা পেয়েছেন এনায়েত হোসেন ভূঁইয়া। তিনি ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
৬০ লাখ ৭০ হাজার টাকায় তেজগাঁওয়ে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট খেলার মাঠে কোরবানি পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. হোসেন খান। তিনি গত বছরও এ হাটের ইজারা পেয়েছিলেন। ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকায় কাওলা শিয়ালডাঙ্গা পশুর হাট পেয়েছেন ভাসানটেক থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম। ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের রহমাননগর আবাসিক প্রকল্পের খালি জায়গায় পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জেহাদ-আল ইসলাম।
এদিকে স্থানীয় এক বাসিন্দার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আফতাবনগরে কোরবানির পশুর অস্থায়ী হাটে স্থগিতাদেশের মেয়াদ দুই মাস বাড়ানো হয়েছে। স্থগিতাদেশ বহাল থাকলে এবার আফতাবনগরে আর কোরবানির পশুর হাট বসতে পারবে না। আফতাবনগরের হাটের জন্য সর্বনিম্ন মূল্য ১ কোটি ৫১ লাখ ৬০ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছিল ডিএনসিসি। ১ কোটি ৬১ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছিলেন আব্দুল মান্নান, তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
মোহাম্মদপুর বসিলা পশুর হাট এ বছর ৭ গুণেরও বেশি দামে ইজারা নিয়েছে একটি প্রতিষ্ঠান, যা টাকার অঙ্কে আড়াই কোটি টাকা বেশি। প্রশ্ন উঠেছে—কী মধু আছে এই হাটে?
জানা গেছে, গত বছর মোহাম্মদপুর বসিলার ৪০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন ‘বসসিলা গার্ডেন’ এলাকায় অস্থায়ী হাটটি ২৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় ইজারা পেয়েছিলেন মেসার্স শাহীন ইন্টারন্যাশনাল। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক আমজাদ হোসেন; তিনি দারুস সালাম থানা আওয়ামী লীগের নেতা। এ বছর নিলামে অংশ নিলেও ইজারা পাননি। উচ্চদামে হাটের ইজারা বাগিয়ে নেন এনায়েত হোসেন ভূঁইয়া। তিনি ক্যাসিনোকাণ্ডে অভিযুক্ত যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।
ক্যাসিনোকাণ্ডে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. হাবিবুর রহমান মিজান গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তারা এই হাট নিয়ন্ত্রণ করতেন। সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তারা ফের মাঠ দখলে নেমেছেন, ফিরে পেতে চান নিজেদের আধিপত্য। এ কারণেই নামসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠানের নামে মোটা অঙ্কের টাকা দেখিয়ে রাজীবের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত এনায়েত হোসেন ভূঁইয়ার নামে হাটটি ইজারা নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে এনায়েত হোসেন ভূঁইয়া বলেন, টাকা উঠবে কি না, জানি না। তবে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে হাট নেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর হাটটি যারা নিতেন এবার তাদের টেক্কা দিতে তা নেওয়া হয়েছে। সাধারণত প্রতিবছর অন্যরা শিডিউল করে হাট নেয়। কিন্তু এবার আমরা শিডিউল দিয়ে হাট নিয়েছি।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ইতোমধ্যে ৮টি অস্থায়ী পশুর হাটের ইজারা চূড়ান্ত হয়েছে। আফতানগরের হাটের বিষয়ে আদালতের রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। এ বছর সব হাটেই আগের থেকে ইজারা দর বেশি পেয়েছি। তবে বছিলা হাটে একটু বেশি টাকা পেয়েছি। কারণ এই হাট নিয়ে এবার প্রতিযোগিতা ছিল। যিনি বেশি দর দিয়েছেন আমরা তাকেই হাট দিয়েছি।