বাবাকে খুঁজতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন দশ বছরের শিশু হোসাইন মিয়া

আচার বিক্রেতা মানিক মিয়া ২০ জুলাই বিকাল ৩টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্দিরগঞ্জের হীরাঝিল এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগ দিতে গেলে তাকে খুঁজতে বেরিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তার দশ বছর বয়সী ছেলে হোসাইন মিয়া।
মানিক মিয়ার (৩৫) পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায়। ১২ বছর আগে কুমিল্লার দেবীদ্বারের রাজামেহার ইউনিয়নের বেতরা গ্রামের আবদুল মোতালেবের মেয়ে মালেকা আক্তার (৩২)কে বিয়ে করে সেখানেই থিতু হন।
শ্বশুরের দেয়া জায়গায় ঘর নির্মাণ করে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে সেখানেই থাকতেন। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে ৫ বছর আগে পরিবার নিয়ে চলে যান নারায়ণগঞ্জের সিদ্দিরগঞ্জের মুক্তিনগরে। সেখানের একটি ভাড়া বাসায় থাকছেন।
নিজে গাড়িতে গাড়িতে আচার বিক্রি করতেন আর স্ত্রী মালেকা বেগম বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। গত এক বছর ধরে মানিক মিয়ার পাশাপাশি স্থানীয় আল হেরা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ১০ বছর বয়সী ছেলে হোসাইন মিয়াও বাসে পপকর্ন ও পানি বিক্রি করতেন।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় যানবাহন বন্ধ থাকায় আচার বিক্রি করতে যেতে পারেননি মানিক মিয়া। তাই ১৫ জুলাইয়ের পর প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্দিরগঞ্জের হীরাঝিল এলাকায় আন্দোলনে যোগ দিতেন। সর্বশেষ ২০ জুলাই বিকাল ৩টায় আন্দোলনে গেলে তাকে খুঁজতে বের হন শিশু ছেলে হোসাইন মিয়া।
মানিক মিয়ার স্ত্রী মালেকা বেগম জানান বিকাল ৪টায় খবর পান তার ছেলে হোসাইন মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তখন তাকে খুঁজতে বের হয়ে স্থানীয়দের কাছে জানতে পারেন সেখানে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ও ক্ষতিকর গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে শিশু হোসাইনসহ কমপক্ষে ১০-১২ জন গুলিবিদ্ধ হন। রিকশায় করে কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান স্থানীয়রা।
মালেকা বেগম ও তার স্বামী মানিক মিয়া তখন রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেলে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে তার ছেলের সন্ধান চাইলেও কেউ কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে রাত ৮টার পর মর্গে গিয়ে ২০-২৫টি লাশের মধ্যে নিজের সন্তান হোসাইন মিয়ার মরদেহ চিহ্নিত করেন।
এ সময় সন্তানের লাশ ও অসংখ্য মানুষের রক্তের পিণ্ড দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন বাবা মানিক মিয়া। মালেকা বেগম আরও বলেন সেদিন ঢাকা মেডিকেলের মেঝেতে রক্তের স্রোত বইছিল। প্রায় দুই ঘণ্টা পর রাত ১০টায় মানিক মিয়ার জ্ঞান ফিরে। এ সময় মানিক ও মালেকা দম্পতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সন্তানের লাশ ফেরত চান।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের কথায় কোনো ধরনের কর্ণপাত করেননি। বরং তাদের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। শেষ পর্যন্ত রাত ১২টার দিকে এক কর্মকর্তা জানান লাশ নিতে হলে মা-বাবা ও তাদের সন্তান হোসাইন মিয়ার জন্মনিবন্ধন আনতে হবে।
সন্তানের রক্তাক্ত মরদেহ হাসপাতালে রেখে মধ্যরাতে বাসায় চলে আসেন মা-বাবা। পরদিন (২১) জুলাই দুপুরে জন্মনিবন্ধনসহ বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে কর্মকর্তাদের কাছে জমা দেন। তারপরও বিভিন্ন হয়রানির পর লাশ বুঝে পান রাত ১২টার পর।
সেদিন রাতেই হোসাইনের লাশ দাদার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে কোনো অ্যাম্বুলেন্স বা অন্য কোনো গাড়িতে করে সেখানে নেয়া সম্ভব হয়নি। তাই রাত ২টায় একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তার মরদেহ নেয়া হয় দেবীদ্বারের বেতরা গ্রামে।
স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত এবং বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীসহ বিপুল সংখ্যক মুসল্লি তার জানাজা ও দাফনে অংশগ্রহণ করেন। তবে প্রশাসনের কেউ আসেননি।
সম্প্রতি শহীদ হোসাইন মিয়ার নানার বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বারের বেতরা গ্রামে গিয়ে কথা হয় তার মা মালেকা বেগম (৩২) ও নানা আবদুল মোতালেব (৬২)-এর সাথে। হোসাইন মিয়ার শাহাদাতের কথা বর্ণনার পাশাপাশি তুলে ধরেন পারিবারিক দারিদ্র্যের কথা তুলে ধরেন মা মালেকা বেগম।
তিনি জানান, হোসাইনের মৃত্যুর ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে সিদ্দিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তবে মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে তার কিছু জানা নেই। তিনি বলেন সন্তান হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন তার বাবা মানিক মিয়া। পুত্র শোকে প্রায় তিন মাস তিনি কোনা কাজে যোগ দিতে পারেননি। তবে সম্প্রতি আবারও বাসে আচার বিক্রি শুরু করেছেন।
মালেকা বেগম জানান, হোসাইন মিয়ার আরও দুই বোন রয়েছে। এর মধ্যে মাহিনুর (৮) স্থানীয় একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিত অধ্যয়নরত। আরেক বোন শাহিনুর (০৫) এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। তিনি জানান তার সন্তানের মৃত্যুর পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তাদেও বাসায় এসে সান্ত্বনা দিয়েছেন। কেউ কেউ আর্থিকভাবে সহায়তা করেছেন।
তিনি আরও জানান, জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫ লাখ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ২ লাখ ও দেবীদ্বার উপজেলা জামায়াতের পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকেও সহায়তার আশ্বাস পেয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন আর্থিক সহযোগিতা পাননি।
শহীদ হোসাইন মিয়ার নানা আবদুল মোতালেব বলেন- আর্থিকভাবে দুর্বল হওয়ায় নিজের মেয়েকে স্বামীসহ থাকার জন্য একটু ঘরের জায়গা দিয়েছেন। তবে আমার নাতিকে এভাবে হারাতে হবে তা ভাবতেও কষ্ট লাগে। তিনি হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন- ফ্যাসীবাদবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের প্রতিটি পরিবারের খোঁজ খবর রাখছি। তাদের পাশে থাকতে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। হোসাইন মিয়ার পরিবারকেও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছি। ভবিষ্যতেও পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব এ এফ এম তারেক মুন্সী বলেন- দেবীদ¦ারের প্রতিটি শহীদ পরিবারের সাথে যোগাযোগ রয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রশাসনেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
কুমিল্লা উত্তর জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ও দেবীদ্বার উপজেলা জামায়াতের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম শহীদ বলেন- হোসাইন মিয়াসহ প্রতিটি শহীদ পরিবারকে আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ সহায়তা দিয়েছি। ভবিষ্যতেও পাশে থাকব।
দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিগার সুলতানা জানান প্রতিটি শহীদ পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে যেকোনো নির্দেশনা আসলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে তিনি জানান। সুত্র-বাসস